Menu
Menu

মাধব কি কহব দৈব বিপাক

গোবিন্দদাস | অভিসার

মাধব কি কহব দৈব বিপাক

পথ আগমন কথা  কত না কহিব হে।

যদি হয় মুখ লাখে লাখ।।

মন্দির তেজি যব  পদ চারি আঅলুঁ

নিশি হেরি কম্পিত অঙ্গ

তিমির দুরন্ত পথ   হেরই না পারিয়ে

পদযুগে বেড়ল ভুজঙ্গ।।

একে কুলকামিনী    তাহে বহুযামিনী

ঘোর গহন অতি দূর।

আর তাহে জলধর   বরিখয়ে ঝরঝর

হাম যাওব কোন পূর।।

একে পদ-পঙ্কজ   পঙ্কে বিভূষিত

কণ্টকে জরজর ভেল।

তুয়া দরশন আশে   কছু নাহি জানলুঁ

চির দুখ তার দূরে গেল।।

তোহারি মুরলি রব   শ্রবণে প্রবেশল

ছোড়লঁ গৃহসুখ আশ।

পন্থক দুখ  তৃণহুঁ করি না গণলুঁ

কহতহি গোবন্দদাস।।

আলোচনা

আলোচ্য পদটি বর্ষাভিসারের। পদটিতে রাধার অভিসার গমনের মানসিকতার, পথের নানা দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিপত্তির এবং পরিশেষে বাঞ্ছিত ফলপ্রাপ্তির চরম উপলব্ধির অতি হার্দিক ও শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে। প্রচণ্ড দুর্যোগের মধ্য দিয়ে শ্রীমতী অভিসার যাত্রা করেছেন। অবশ্য যাত্রাপথ যত বিঘ্নসঙ্কুল, অভিসারের বৈচিত্র্য বুঝি তত বেশি৷ কারণ এর দ্বারাই তো দয়িতার মনঃপ্রকৃতি, সঙ্কল্প, শক্তি, প্রেমের গভীরতার সীমা ধরা পড়ে।

আরো পড়ুন :  রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভাের

শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুমধুর সুর শুনে সেদিনই শ্রীমতী তাঁকে মনপ্রাণ সমর্পণ করেছিলেন। এখন মিলনের দুর্নিবার আকর্ষণে তিনি, ‘তিমির দুরস্ত পথে’ বেরিয়ে পড়েছেন, যে পথ কর্দম-পিচ্ছিল, কণ্টকাকীর্ণ, সূচীভেদ্য অন্ধকারে আচ্ছন্ন। শ্রীমতী তো কুলকামিনী, বাইরের জগৎ তাঁর কাছে অপরিচিত। অন্ধকার পথের দিশাও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। হঠাৎ সাপ দু’পায়ে বেড়ি দিয়ে ধরল। কিন্তু তাঁর কঠোর সঙ্কল্পের কাছে কোনও বাধাই বাধা নয়। পিচ্ছিল পথে চলতে গিয়ে শ্রীমতী আছড়ে পড়ছেন, তাঁর কোমল পা দুখানি কাঁটায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। তবু তিনি সঙ্কেতকুঞ্জ অভিমুখে এগিয়ে চলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি মাধবের দেখা পেলেন। ফলে তাঁর দেহ-মনের সব কষ্টের অবসান হল। দুঃখের মেঘখণ্ড সরে গিয়ে তাঁর মনের আকাশে ছড়িয়ে পড়ল আনন্দের চন্দ্রকিরণ।

আরো পড়ুন :  কি মােহিনী জান বঁধু কি মােহিনী জান

বস্তুত, অভিসারের কষ্টিপাথরে রাধার প্রেমের উৎকর্ষ, গভীরতা ও গাঢ়তর পরীক্ষা লক্ষণীয়। বর্তমান পদটিতে তার পরিচয় লভ্য। সত্য বটে, গোবিন্দদাস বৈষ্ণব রসতত্ত্বের প্রদত্ত মানদণ্ডটি অবলম্বনে এবং তাঁর কাব্যগুরু বিদ্যাপতির বর্ষাভিসার বর্ণনার পথ অনুসরণে শ্রীরাধার অভিসার বর্ণনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। 

কিন্তু ভাবের আন্তরিকতায়, বর্ণনায় পারিপাট্যে, ছন্দের নূপুর নিক্কণে, শব্দের ঝঙ্কার ও ভাবসমারোহে এই পদটিতে গোবিন্দদাস কবি প্রতিভার বিজয় বৈজয়ন্তী উড়িয়েছেন। পথের দুঃখ-কষ্টের বর্ণনার শেষে মাধবের সম্মুখে উপনীতা রাধা যখন অনুভবের গাঢ়তায় সব যন্ত্রণার অবসানের কথা জানান, তখন কোনও শব্দঝঙ্কার নয়, এক আশ্চর্য ভাবনাময় মোহমদির মন নিয়ে নিজেকে পরম বাঞ্ছিতের পদে সঁপে দিয়ে যেন কৃতকৃতার্থ হন। প্রেমসাধনার সেটাই তো শেষ কথা !

error: Content is protected !!